টি
এস এলিয়ট
‘ইতিহাসের পরিকল্পিত অলিন্দ ও চতুর পথ
’ এর কথা বলেছিলেন । ফলেই
একটি দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানচিত্রের সাথে সে অঞ্চলের ওপর একটি
নির্দিষ্ট সময়খণ্ডে ইতিহাসের চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক সীমার সামঞ্জস্য
না থাকাটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয় । আসামের দক্ষিণাঞ্চলের কাছাড়, করিমগঞ্জ
ও হাইলাকান্দি জেলা নিয়ে গঠিত বরাক উপত্যকা নামের আজকের জনপদ এই অসামঞ্জস্যের
সবচেয়ে বড় প্রমাণ । একই সঙ্গে এটাও সত্য, উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্য প্রতিবেশি
অঞ্চলের চেয়ে সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই অঞ্চল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ।
ভৌগোলিক, ভাষিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিগত দিক থেকে বরাক উপত্যকা বাংলার
পূর্বাঞ্চলেরই স্বাভাবিক সম্প্রসারণ । ১৮৭৪ সালে বিট্রিশ ঔপনিবেশিক
শক্তি আসামকে রাজ্য হিসাবে গঠন করার সময় নতুন রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতির
সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বঙ্গভাষী সিলেট
ও কাছাড় জেলাকে কেটে এনে আসাম রাজ্যের সাথে জুড়ে দেয় । সুরমা উপত্যকা
নামে একটি নতুন কমিশনার শাসিত প্রশাসনিক বিভাগের জন্ম হয় এই দুই জেলা
নিয়ে । ১৯৪৭ সালে এই বিভাগের সিলেট জেলার সিংহভাগ অংশ হস্তান্তরিত হয়
পূর্ব পাকিস্তানে । সুরমা উপত্যকার এপারে পড়ে থাকা বাকি অংশকেই এখন বলা
হয় বরাক উপত্যকা, যা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা নামে তিনটি
জেলায় পরবর্তীতে পুনর্গঠিত হয় । প্রকৃতপক্ষে, সুরমা-বরাক অঞ্চল অর্থাৎ
বিভাগ-পূর্ব সিলেট ও কাছাড় স্মরণাতীত কাল থেকেই একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক
ভূগোলের অংশ । — উপরোক্ত অংশ এ অঞ্চলের সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী
ও সমাজকর্মী ড০ সুজিৎ চৌধুরীর একটি নিবন্ধের, যেখানে তিনি অঙ্গুলি
নির্দেশ করেছেন এ অঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্র ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের দিকে । এই পরিপ্রেক্ষিতেই এ অঞ্চলের
সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে ইতিহাস চর্চা অবধি সব ধরনের বৌদ্ধিক
ও সৃজনাত্মক কাজকর্ম এক সংগ্রামী সমাজকর্মের চরিত্র অর্জন করে । আজ
অবধি এ রাজ্যের ক্ষমতার মসনদে থাকা সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিগুলি এখানকার
ভাষিক পরিচয়কে অস্বীকার করে ইতিহাস বিকৃত করার চক্রান্ত করে এসেছে । অন্যদিকে
এ অঞ্চলের জনগণ বিশেষ করে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ লড়াই করে
এসেছেন এখানকার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করার । এটা সকলেরই জানা
যে বরাক উপত্যকাবাসী অসমিয়াভাষী মানুষ এখানকার মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র
এক অংশ । আবার এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই চাকুরি সূত্রে বরাক উপত্যকায়
বদলি হয়ে আসা অস্থায়ী বাসিন্দারা । কিন্তু এই সত্যটি জেনেও আসাম সরকারের
সরকারি ওয়েব সাইটে বরাক উপত্যকার তিনটি জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি
জেলার প্রধান ভাষা বলা হয়েছে অসমিয়া ভাষাকে । সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের
ভাষা বাংলাকে জায়গা দেওয়া হয়েছে হিন্দির পরে তৃতীয় স্থানে । বরাকের
আধুনিক ইতিহাস এমনই ছলনাময় ।
উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিত থেকেই প্রাচীন ও আধুনিক, দু’টি সময়ের ইতিহাস
নিয়ে চর্চা বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ ।